ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা কি ধর্মনিরপেক্ষ? part:1
লিখেছেন লিখেছেন এমএ হাসান ১৭ আগস্ট, ২০১৩, ০৩:০৬:১৯ দুপুর
সাংবিধানিকভাবে ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ
রাষ্ট্র। সে দেশের সংবিধানের ১৫(১) ধারায়
বলা হয়েছে, "The State shall not
discriminate against any citizen on
grounds only religion, race, caste,
sex, place of birth or any of them."
বাস্তবে কিন্তু এ ধারাকে নানাভাবে লঙ্ঘন
করা হচ্ছে। অহিন্দুদের মৌলিক নাগরিক
অধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে হিন্দু
নেতারা যে আন্তরিক ছিলেন না, তার প্রমাণ
সংবিধান পাস হওয়ার সাথে সাথে এর
সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে Directive
Principle. এ নীতির মূল কথা হচ্ছে জাতীয়
সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার নাগরিক সাধারণ
বিধিমালা (Civil Code) তৈরি ও প্রয়োগ
করবে। সহজ কথায় এর অর্থ হচ্ছে,
সবাইকে হিন্দু বানাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
উল্লেখিত নাগরিক সাধারণ বিধিমালা (Civil
Code)'র আওতায় অভিন্ন বিধি চালু করার
নামে ইসলামের উত্তরাধিকার, বিবাহ, তালাক
প্রভৃতি আইনকে পরিবর্তন করার চেষ্টা অহরহ
চলছে। কিন্তু মুসলমানদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সন্যাল ল' বোর্ড'র
তীব্র বিরোধিতার কারণে সরকার এ পর্যন্ত
তা বাস্তবায়িত করতে পারেনি। তবে আরএসএস,
বিশ্বহিন্দু পরিষদ প্রভৃতি হিন্দুত্ববাদী দল এ
ব্যাপারে সরকারের উপর চাপ অব্যাহত রেখেছে।
এ নীতির আওতায় ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায়
সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য,
চিন্তা-চেতনা এবং ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার
প্রতিফলন হয়েছে। এ কারণেই দেখা যায়,
সে দেশের পাঠ্যক্রমে রয়েছে হিন্দু সংস্কৃতির
নানাবিধ আচার-আচরণ, মূর্তি-পূজার মাহাত্ম্য,
পৌরাণিক বীরপুরুষদের কাহিনী ইত্যাদি। পাঠ্য
পুস্তকগুলো হিন্দু দেব-দেবীদের
কাহিনীতে ভরপুর। শিক্ষা বোর্ডের নির্ধারিত
পুস্তকের পাঠে রয়েছে মুসলমানগণ কর্তৃক হিন্দু
নারীদের উপর জুলুম-অত্যাচার, ধর্ষণ,
বলপ্রয়োগ দ্বারা মুসলমান
বানানো ইত্যাদি কল্প-কাহিনী এবং হিন্দু
দেবদেবীকে পূজা করার জন্য কচি শিশুদের
উৎসাহ দান। এ হচ্ছে সাধারণভাবে সরকারি ও
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিলেবাসের
বৈশিষ্ট্য। নিবন্ধের আকারকে সীমিত রাখার
উদ্দেশ্যে এ আলোচনা কেবল আরএসএস
(রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবকসংঘ) পরিচালিত
বেসরকারি শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে সীমিত
থাকবে।
আরএসএস'র শিক্ষা কার্যক্রম : আরএসএস
(রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবকসংঘ) হচ্ছে ভারতের
সবচেয়ে বড় হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। এ সংগঠনের
রাজনৈতিক ফ্রণ্ট বিজেপি কেন্দ্রে ও বিভিন্ন
প্রদেশে সরকার গঠন করেছে। আরএসএস
অত্যন্ত
সুপরিকল্পিতভাবে সারা ভারতে প্রতিষ্ঠা করেছে হাজারো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
হিন্দুত্ববাদ প্রচারের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার
গুরুত্ব যে সর্বাধিক, এ অনুভূতি থেকেই
আরএসএস এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন
করেছে। ভারতের প্রত্যেকটি প্রদেশ ও
অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত এসব
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পরিচালনার
দায়িত্বে রয়েছে বিভিন্ন নামের নানা সংগঠন।
আরএসএস'র প্রতিষ্ঠিত এসব
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেশের শিক্ষা বিভাগের
কারিকুলাম ও দিক-নির্দেশনা (Guidelines)
অনুসরণ করা হয়, তবে শিক্ষার্থীদের
মনে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢুকিয়ে দেবার জন্য
রয়েছে অতিরিক্ত পাঠ্যপুস্তকসহ
শিক্ষা বহির্ভূত বাড়তি নানা কার্যক্রম। এসব
পাঠ্যপুস্তক তৈরি করার জন্য রয়েছে ‘সংস্কার
ভারতী প্রকাশন' এবং ‘ভারতীয় শিক্ষা সমিতি'
নামের বিশেষ প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান। সংঘ
পরিবারই এসব
প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানকে পরিচালনা করে থাকে।
বিদ্যাভারতী : আরএসএস ‘বিদ্যাভারতী'
নামে স্কুলের এক বিরাট নেটওয়ার্ক
প্রতিষ্ঠা করেছে। এসব স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের
যে শিক্ষা দেয়া হয়, তার
দ্বারা তারা হিন্দুত্ববাদের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়
এবং হিন্দুত্বের জন্য ভবিষ্যৎ জীবনে যে কোন
ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত হয়।
বিদ্যাভারতী স্কুল সর্বপ্রথম
প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ১৯৫২ সালে।
পরবর্তীকালে এসব স্কুল অত্যন্ত
ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করেছে। ১৯৯৮
সালে এসব স্কুলের সংখ্যা ছিল ১৯,৭৪১। তখন
এসব স্কুলে ছিল চবিবশ লাখ ছাত্র-
ছাত্রী এবং সত্তর হাজারেরও অধিক শিক্ষক।১
পরবর্তী বছরগুলোতে এসব সংখ্যা যে অনেকগুণ
বেড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।
বিদ্যাভারতী স্কুলগুলো বেসরকারি হলেও
ভারতের কেন্দ্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড
(CBSE) এবং প্রাদেশিক সরকারের
শিক্ষা বোর্ডের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে।
অঞ্চলভেদে বিদ্যাভারতী স্কুলগুলোর জন্য
বিভিন্ন নাম রাখা হয়েছে। এসব নামের
মধ্যে রয়েছে বিদ্যাভারতী, জ্ঞানভারতী,
সরস্বতী মন্দির, গীতা নিকেতন, বিবেকানন্দ
বিদ্যালয় ইত্যাদি।
সারা ভারতব্যাপী যেসব বিদ্যাভারতী স্কুল
রয়েছে সেগুলোর শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের
জন্য রয়েছে বিদ্যাভারতীর তৈরি ওয়ার্কবুক
সিরিজ। এসব পুস্তক অনুসরণ
করে শিক্ষা দেয়া হয় সংস্কৃতি জ্ঞান। সংস্কার
সম্পর্কে এসব
স্কুলে ব্যাপকভাবে আলোচনা করা হয়।
সংস্কার শিক্ষার মধ্যে রয়েছে সংস্কৃত ভাষায়
প্রার্থনা, শিক্ষকদের আচার্য
বলা এবং শিক্ষকদের পদধূলি নেয়া। পরিবেশ
সচেতনতা জাগাবার উদ্দেশ্যে স্কুল
ক্যাম্পাসে রোপণ করা হয় তুলসী গাছের চারা,
যা হিন্দুদের নিকট অতি পবিত্র। স্কুলগুলোর
দেয়াল জুড়ে রয়েছে হিন্দুত্ববাদ প্রবর্তকদের
চিত্র। এরা হলেন আরএসএস'র আদর্শিক গুরু
গোলওয়াকার, আরএসএস প্রতিষ্ঠাতা হেজওয়ার,
আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠাতা শঙ্করাচার্য দয়ানন্দ
সরস্বতী, বিবেকানন্দ, শিবাজী, রানা প্রতাপ,
সুভাষচন্দ্র বসু, চন্দ্রশেখর আজাদ
এবং বল্লবভাই প্যাটেল। লক্ষণীয়, এসব
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনটার দেয়ালেই
ভারতবাসীর জাতীয় পিতা করমচাঁদ মোহনদাস
গান্ধীর চিত্র নেই।
পাঠ্যক্রম
বিদ্যাভারতী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংস্কৃতি জ্ঞান
পাঠ্যক্রমের আওতায় যা শিখানো হয় তার
কিছুটা নমুনা নীচে দেয়া গেল :
০ সর্বপ্রথম যারা চীন দেশে বসতি স্থাপন
করে তারা ছিল ভারতীয়।
০ সর্বপ্রথম যারা ইরানে বসতি স্থাপন করেছিল
তারা ছিল ভারতীয়।
০ মূর্তিপূজা বিরোধী ইসলামের অনুসারী হাজার
হাজার লোক মুসলিম সম্প্রদায়ের হজ্বকেন্দ্র
কাবায় যায় শিবলিঙ্গ পূজা করার জন্য।২
আরও শিখানো হয় :
০ তাজমহলে আসলে কোন কবর নেই,
এটা একটি হিন্দু মন্দির।
০ ভারত একটি অতি উন্নত দেশ,
এখানে একটি সবুজ বিপ্লব চলছে।
০ ভারতে সবচেয়ে অধিক দুধ উৎপাদন হয়।
ডেনমার্কের দুগ্ধ উৎপাদনকারী গাভী ভারত
থেকে নেয়া হয়েছে।
০ গাভী আমাদের মা। এদের ভেতর দেবতাগণ
অবস্থান করেন। গাভীর
মাথা যেদিকে থাকে সেদিক থেকে প্রবাহিত হয়
বিশুদ্ধ হাওয়া। গোমূত্র ব্যতীত ক্যান্সারের
আর কোন ওষুধ নেই।৩
কিছুদিন পূর্বে বিদ্যাভারতী স্কুলে ছাত্র-
ছাত্রীদের জন্য তৈরি কিছু প্রশ্ন ও উত্তর ছিল
নিম্নরূপ :
প্রশ্ন : বাবরী মসজিদকে মসজিদ
বলা যাবে না কেন?
উত্তর : কারণ, আজ পর্যন্ত কোনদিন
মুসলমানগণ সেখানে নামায পড়েনি।
প্রশ্ন : ১৫২৮ এবং ১৯১৪ সালের মধ্যে কতজন
রামভক্ত রামমন্দিরকে মুক্ত করার জন্য প্রাণ
বিসর্জন দিয়েছেন?
উত্তর : তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার জন।
আরও কয়েকটি প্রশ্ন ছিল নিম্নরূপ :
০ কখন রামভক্ত করসেবকগণ শ্রীরাম
জন্মভূমির উপরে গেরুয়া পতাকা উত্তোলন
করেছিল?
০ গেরুয়া পতাকা উত্তোলনকালে যেসব তরুণ
প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল, তাদের নাম উল্লেখ
করো
আরএসএস কর্তৃক প্রবর্তিত পাঠ্যপুস্তকের মূল
ফোকাস হচ্ছে ধর্মীয়
উন্মাদনা এবং বাণী হচ্ছে সাম্প্রদায়িক চেতনার
উপর। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি,
পৌরাণিক কাহিনী, মুসলমান শাসকদের
(কল্পিত) জুলুম-অত্যাচারের কথা এবং তাদের
বিরুদ্ধে পরিচালিত হিন্দু রাজাদের (কল্পিত)
বীরত্বগাঁথা, এসবই হচ্ছে ঐসব পুস্তকের মূল
উপাদান। সাম্প্রদায়িকতার যে মূল বাণী এসব
পুস্তকে রয়েছে, তরুণ শিক্ষার্থীদের
মনে তা গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এ
কারণেই বলা যায়, বিদ্যাভারতী স্কুলগুলোই
হচ্ছে হিন্দু সাম্প্রদায়িক প্রপাগান্ডার সর্বাধিক
কার্যকরী বাহন এবং হিন্দুত্ববাদী ক্যাডার
রিক্রুট করার উর্বরতম ভূমি। একটি স্কুল
থেকে প্রতি বছর যদি মাত্র পঞ্চাশজন
ছাত্রছাত্রী বের হয়, তবুও সংঘপরিবারের
আদর্শিক সমর্থকদের সংখ্যা হবে প্রচুর। এ
কারণেই বলা হয়, বিদ্যাভারতী স্কুল
হচ্ছে সংঘপরিবারের স্বর্ণখনি।
বিষয়: বিবিধ
১১০৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন